সম্পাদকীয়:
আজ ১ মে, ২০২৫। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। একটি দিন, যা বহন করে চলেছে বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘশ্বাস, রক্ত আর অধিকার আদায়ের অদম্য স্পৃহার ইতিহাস। ১২৭ বছর আগে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যে জীবনপণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতেই বিশ্বজুড়ে পালিত হয় এই মহান মে দিবস।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শিল্পায়নের উন্মাদনা যখন তুঙ্গে, তখন শ্রমিকশ্রেণি সম্মুখীন হয়েছিল এক ভয়াবহ বাস্তবতার। অমানবিক কর্মঘণ্টা, যৎসামান্য মজুরি আর নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কলকারখানার বদ্ধ পরিবেশে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনি তাদের জীবনীশক্তি কেড়ে নিচ্ছিল। এই শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প ছিল না।
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ফেডারেশন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য জোরালো দাবি জানায় এবং মালিকপক্ষকে ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়। কিন্তু পুঁজিবাদী ঔদ্ধত্য শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে পদদলিত করতে দ্বিধা করেনি। তারা শ্রমিকদেরকে নিছক উৎপাদন যন্ত্র হিসেবে গণ্য করত, যাদের কোনো মানবিক অধিকার থাকতে পারে না।
এই অন্যায় ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে শিকাগোর শ্রমজীবী মানুষ। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে, প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক রাজপথে নেমে আসে। তাদের কণ্ঠে ছিল অধিকারের হুঙ্কার, চোখে ছিল উন্নত জীবনের স্বপ্ন। হে মার্কেটে লাখো শ্রমিকের শান্তিপূর্ণ মিছিল এক ঐতিহাসিক দৃশ্যের জন্ম দেয়। লাল পতাকা হাতে, ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকদের দৃপ্ত পদভারে কেঁপে ওঠে শিকাগোর মাটি।
কিন্তু শ্রমিকদের এই ন্যায্য প্রতিবাদ মেনে নিতে পারেনি ক্ষমতালোভী মালিকশ্রেণি। তাদের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে চালানো হয় গুলি, ঝরে যায় বহু শ্রমিকের অমূল্য প্রাণ। স্যামুয়েল ফিল্ডেন সহ নাম না জানা অসংখ্য শ্রমিক সেদিন তাদের রক্ত দিয়ে লিখে গিয়েছিলেন অধিকার আদায়ের প্রথম কবিতা। আহত হন আরও অগুনতি মানুষ।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৪ মে হে মার্কেটে আবারও শ্রমিকরা বিক্ষোভের জন্য সমবেত হন। শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রহস্যময় বোমা হামলায় এক পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেদিন আরও ১০-১২ জন নিরীহ শ্রমিক নিহত হন, আহত হন অগুনতি। পরবর্তীতে, মিথ্যা ও সাজানো মামলায় অনেক শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েকজনকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে, শিকাগোর শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের বুকের রক্ত বিফলে যায়নি। এই মর্মান্তিক ঘটনা বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ঐক্য ও সংহতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। শিকাগোর রক্তাক্ত ইতিহাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের স্পৃহাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এর ফলস্বরূপ, ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনকালে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে শিকাগোর শ্রমিকদের আত্মত্যাগের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার প্রস্তাব করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের মূলমন্ত্রে পরিণত হয় এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হয়।
আজ, সেই ঐতিহাসিক দিনের স্মরণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পালিত হচ্ছে মে দিবস। সরকারি ছুটির এই দিনে শ্রমিক সংগঠনগুলো র্যালি, সমাবেশ ও আলোচনা সভার মাধ্যমে তাদের অধিকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য – ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’ – মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, যা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে অপরিহার্য।
আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, মে দিবস কেবল একটি গতানুগতিক ছুটির দিন নয়। এটি সেইসব অকুতোভয় শ্রমিকদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের আজকের কর্মপরিবেশ আর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। তাদের সেই রক্তমাখা পথ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সাহস যোগায়।
তবে, অধিকার অর্জনের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না, আজও নয়। বিশ্বের বহু প্রান্তে আজও শ্রমিকরা শোষণ, বঞ্চনা আর অমানবিক কর্মপরিবেশের শিকার। বাংলাদেশেও শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মস্থল এবং অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখনও जारी রয়েছে। পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা আজও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই প্রেক্ষাপটে, এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’ একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী বার্তা বহন করে। একটি স্থিতিশীল ও উন্নত অর্থনীতির জন্য শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, বোঝাপড়া ও আস্থা অপরিহার্য। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মালিকদেরও শ্রমিকবান্ধব নীতি গ্রহণ করা উচিত। উন্নত কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি এবং শ্রমিকদের প্রতি মানবিক আচরণই একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারে।
আসুন, আজকের এই মহান দিনে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। শ্রমিক-মালিকের মধ্যে বিদ্যমান যেকোনো দূরত্ব ঘুচিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করি। শিকাগোর সেই আত্মত্যাগী শ্রমিকদের চেতনা আমাদের পথ দেখাক, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলুক নিরন্তর – এটাই হোক আজকের দিনের সম্মিলিত প্রত্যয়। মে দিবসের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অধিকার কখনও ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না, তা অর্জন করতে হয় সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে।