আ.ন.ম শহীদ উদ্দিন ছোটন
কুতুবদিয়ার মানুষের আজীবনের দুঃখ ঘাট পারাপার। বিশেষ করে বড়ঘোপ – মগনামা ও দরবার – মগনামা ঘাট পারাপার। জন্ম থেকেই দেখে আসছি বড়ঘোপ ঘাটের হয়রানির করুণ চিত্র। প্রতিবাদ যে কেউ করেনি তা কিন্তু নয়। ঘাটের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক সময় নৌকা থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল কুতুবদিয়া তথা কক্সবাজার জেলার কৃতি সন্তান মরহুম জালাল আহমদ চৌধুরী, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মরহুম হাফেজ মাওলানা মহি উদ্দিন, কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম ছৈয়দ আহমদ কুতুবীসহ আরও অসংখ্য সাধারণ দ্বীপবাসীকে।
আজ সময় এসেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে দ্বীপবাসীদের ঘাট পারাপারের যৌক্তিক সমাধানের। অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মনে প্রশ্ন, কুতুবদিয়ার পারাপার ও জেটিসমূহের ইজারা কর্তৃপক্ষ কে বা কারা, কেন জেটি ও পারাপার ইজারা দেওয়া হচ্ছে, ইজারা না থাকলে সমস্যা কোথায়, কক্সবাজার-মহেশখালী পারাপারে ইজারা নেই, কুতুবদিয়ায় কেন থাকবে, ইজারার টাকা কোথায় যায়, সরকারিভাবে ফেরি বা সি-ট্রাক দিতে সমস্যা কোথায় ইত্যাদি।
কুতুবদিয়ার যে কয়টি ঘাট ও জেটি রয়েছে তন্মধ্যে বড়ঘোপ-মগনামা, দরবার-মগনামা, আলী আকবর ডেইল-মগনামা পারাপার ও দরবার জেটি, আলী আকবর ডেইল জেটি এবং ধূরুং জেটির ইজারা কর্তৃপক্ষ হলেন জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার। বড়ঘোপ জেটির ইজারা কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ, মগনামা জেটির ইজারা কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার জেলা পরিষদ, ধূরুং-ছনুয়া পারাপার ইজারা কর্তৃপক্ষ হলেন বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম এবং ছনুয়া জেটির ইজারা কর্তৃপক্ষ হলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বাঁশখালী। অর্থাৎ আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে ৫টি কর্তৃপক্ষ কুতুবদিয়ার পারাপার ও জেটির ইজারার সহিত সংশ্লিষ্ট। আর এই আইনি মারপ্যাঁচের কারণেই দ্বীপবাসীদের হয়রানির অবসান হচ্ছে না বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
কুতুবদিয়া হতে মগনামা বা ছনুয়া পারাপার ইজারা না দেওয়া বা ইজারা পদ্ধতি বাতিল করলে সমস্যা কোথায়? যদি ইজারা না দেওয়া হয় তাহলে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যা সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। কারণ নৌকা যারা চালাবে তাদের উপর যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না তেমনি যথাসময়ে নৌকা না ছাড়লে প্রতিবাদ করার সুযোগও থাকবে না। তাছাড়া ইজারার টাকা দিয়েই কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সম্মানী ভাতার অর্ধেক এবং গ্রাম পুলিশদের বেতন ভাতার অর্ধেক পরিশোধ করা হয়।
বড়ঘোপ – মগনামা, দরবার – মগনামা পারাপার এবং দরবার জেটি ও আলী আকবর ডেইল জেটির ইজারার টাকার ১% সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হয়। বাকি টাকার অর্ধেক কুতুবদিয়া উপজেলা এবং অর্ধেক পেকুয়া উপজেলা পায়। উপজেলা হতে উক্ত টাকা জনসংখ্যা ও এলাকা হিসাবে ইউনিয়ন পরিষদে বরাদ্দ করা হয় যা দিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সম্মানী অর্ধেক এবং গ্রাম পুলিশদের বেতন ভাতার অর্ধেক পরিশোধ করা হয়। কিছু টাকা এলাকার উন্নয়নেও ব্যয় করা হয়।
কক্সবাজার – মহেশখালী পারাপার ইজারা হয় না কিন্তু কুতুবদিয়ায় কেন ইজারা হয় তা নিয়ে অনেকে চিন্তিত। কক্সবাজার-মহেশখালী ইজারা হয় না, তা খাস কালেকশনের মাধ্যমে চলে অর্থাৎ সরাসরি জেলা প্রশাসকের অধীনে পারাপারের টাকা আদায় করা হয়। কারণ উক্ত ঘাট কক্সবাজার পৌরসভা ও মহেশখালী পৌরসভার মধ্যে হওয়াতে ইজারা কর্তৃপক্ষ নির্ধারণে আইনগত জটিলতার কারণে খাস কালেকশনের মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে।
অনেকে দাবি জানাচ্ছে সরকারিভাবে ফেরি বা সি-ট্রাক সার্ভিস চালু করার জন্য। ১/১১ সরকারের সময় আমার বড় ভাই সাবেক সচিব জনাব আ.ম.ম. নাসির উদ্দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সি-ট্রাক সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক আর্থিক ক্ষতির কারণে সরকার তা বন্ধ করে দেয়। ফেরি সার্ভিস চালু করার জন্য আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় উপজেলা সমন্বয় সভায় অনেক গলাবাজি করেছি কিন্তু আমার দাবিকে পরিষদের চার দেয়ালের বাইরে নিতে পারিনি যা আমার চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
ফেরির দাবি উত্থাপন করে ব্যর্থ হওয়ার পর BOOT পদ্ধতিতে (Build – Own – Operate and Transfer) ফেরি সার্ভিসের প্রস্তাব পরিষদে পাশ করিয়েছিলাম এবং পাশকৃত প্রস্তাব অনুসারে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে একখানা প্রস্তাবনা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভোট ডাকাতির মাধ্যমে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার পর তা আর আলোর মুখ দেখেনি এবং সেটাই দ্বীপবাসীর জন্য চরম দুর্ভাগ্য বলে মনে করি।
ছাত্র-জনতার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বড়ঘোপ-মগনামা পারাপারের ইজারা দেওয়ার জন্য জেলায় যে আইনানুগ ইজারা কমিটি আছে, বড়ঘোপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে উক্ত ইজারা কমিটির একজন সদস্য হলেও আমার ২ বছরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ২ বারের একবারও মিটিংয়ে ডাকা হয়নি। আমলারাই নিজেদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে সাজানো কাগজপত্রর মাধ্যমে ইচ্ছামাফিক ইজারা দিয়ে দেন।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুতুবদিয়ার পক্ষে কুতুবদিয়ার ঘাট পারাপারের যৌক্তিক সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে এবং উক্ত যৌক্তিক দাবির প্রতি দ্বীপের ছাত্র-জনতা সর্বাত্মকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। আশাকরি ছাত্র-জনতার চাওয়া শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে ইনশাল্লাহ।
আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, বড়ঘোপ -মগনামা পারাপারের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে হলে BOOT পদ্ধতিতে ফেরি সার্ভিস চালু করতে হবে। তবে তা বাস্তবায়ন করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ (সরকারের অনুমতিসহ ৭/৮ মাস লাগতে পারে)। বিধায় আপাতত আলোচনার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার ৬ দফা বাস্তবায়ন করা দ্বীপবাসীদের স্বার্থে একান্ত আবশ্যক।
আশা করি, এই সংশোধনীর মাধ্যমে আপনার লেখার ভাবার্থ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আপনার উদ্যোগ এবং দ্বীপবাসীর প্রতি আপনার আন্তরিকতা প্রশংসার যোগ্য।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান
বড়ঘোপ, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার
সভাপতি, কুতুবদিয়া উপজেলা প্রেসক্লাব