ভারুয়াখালী-খুরুশকুল সংযোগ সেতু: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও স্বপ্ন অধরা, হতাশায় স্থানীয়রা

উপজেলা কক্সবাজার কৃষি ক্যাম্পাস ক্রিড়া ও সংস্কৃতি গণমাধ্যম জীবনযাপন পরিবেশ বিশেষ প্রতিবেদন ব্যবসা ও বাণিজ্য মতামত
নির্মাণাধীন সেতু ও খেয়া পারাপারের দৃশ্য

অনুসন্ধানী প্রতিবেদক (আলী ওসমান শেফায়েত):

কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালী ইউনিয়নের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন – একটি সংযোগ সেতু – যেন আজ গভীর হতাশায় রূপ নিয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে অনানুষ্ঠানিক এবং ২০০৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৯২ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এই খবরে অঞ্চলের মানুষের চোখেমুখে দেখা দিয়েছিল নতুন দিনের আলো।

বর্তমানে ভারুয়াখালী থেকে জেলা শহর কক্সবাজারে পৌঁছাতে স্থানীয়দের প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এই দুরূহ যাত্রায় তাদের ৩-৪টি যানবাহনের পরিবর্তন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এবং দৈনিক গুনতে হয় প্রায় ১৫০-২০০ টাকা। সময়ও লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। সেতুটি নির্মিত হলে এই দূরত্ব কমে দাঁড়াবে মাত্র ৮-৯ কিলোমিটারে, যাতায়াত খরচ নেমে আসবে ৩০-৩৫ টাকার মধ্যে এবং সময় লাগবে মাত্র ২০-২৫ মিনিট। নিঃসন্দেহে এটি এখানকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আনবে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন। জীবিকা নির্বাহ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য এই অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ কক্সবাজার শহরের উপর নির্ভরশীল। দীর্ঘ পথ এবং অতিরিক্ত খরচ তাই তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।

তবে, সেই স্বপ্ন পূরণের আশা এখন ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। ২০১৮ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও বর্তমানে এর অগ্রগতি হতাশাজনক। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশের মতো কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেতু বাস্তবায়ন কমিটির নেতৃবৃন্দ মাস্টার মুহাম্মদ শেফা উদ্দিন, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ ইউনুস, ব্যবসায়ী আরাফাত উল্লাহ এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তারেক আল আজিজসহ আরও অনেকে দীর্ঘদিন ধরে এই সেতুর জন্য অক্লান্তভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। তাদের স্পষ্ট অভিযোগ, কাজ শুরুর পর থেকে কখনোই ১০ জনের বেশি শ্রমিককে নিয়মিতভাবে কাজে লাগানো হয়নি, যা এই কাজের কচ্ছপগতির অন্যতম প্রধান কারণ।

ভারুয়াখালী নদীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতীক্ষায় থাকা এই সেতুটির নির্মাণ কাজ কয়েক ধাপ পিছিয়ে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান কাজের মন্থর গতি স্থানীয়দের মনে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে।

খুরুশকুল মুনিরিয়া দাখিল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক, লেখক ও গবেষক (ভারুয়াখালীর ইতিহাস গ্রন্থের লেখক) এবং সেতু বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক শেফা উদ্দিন ক্ষোভের সাথে বলেন, “কক্সবাজারের ভারুয়াখালীর মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এই ভারুয়াখালী-খুরুশকুল সংযোগ সেতু। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এর নির্মাণ কাজ চলছে কচ্ছপের গতিতে, যা আমাদের হতাশ করছে। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ অধ্যুষিত এই ইউনিয়নের জেলা শহরে যেতে যেখানে ৮ কিলোমিটারের পথ, সেখানে সেতু না থাকায় আমাদের ৩০-৩৫ কিলোমিটার ঘুরতে হচ্ছে। এতে আমাদের মূল্যবান সময় ও কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় হচ্ছে। উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও লবণের ন্যায্য দাম পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে, এমনকি মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে নিতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রতিদিন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেয়া পার হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। সেতু নির্মাণে শ্রমিক সংকট এবং কাজের এই ধীরগতিতে ২০৩০ সালের আগে কাজ শেষ হওয়াও কঠিন। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ঈদের পর পুরোদমে কাজ শুরুর আশ্বাস দিয়েছেন, তবে আমাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। যেহেতু এই সেতু নির্মাণের পিছনে আমার এলাকার কম-বেশি সকলের অবদান আছে, এমনকি দোয়ার মাধ্যমেও অনেকে অবদান রেখেছেন। তাই ভারুয়াখালীর মানুষ হিসেবে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত এই সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমরা আর এই দুর্ভোগ সহ্য করতে পারছি না।”

কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সেতু বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ইউনূস হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালীর ৪০ হাজার মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ এই ভারুয়াখালী-খুরুশকুল সংযোগ সেতু, যা শহর থেকে দূরত্ব কমিয়ে আনবে এক-চতুর্থাংশে এবং প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রাপ্তি সহজ করবে। ১৯৯৫ সাল থেকে সেতুটির জন্য আন্দোলন চললেও, ২০১৭ সালে অনুমোদন ও ২০১৯ সালে কাজ শুরুর পরেও নির্মাণ গতি হতাশাজনক। স্থানীয়দের ধারণা, রাজনৈতিক কারণে বিলম্বিত এই কাজ শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেতু দাবি কমিটির তৎপরতায় এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের গতি বাড়লেও, সাম্প্রতিককালে তা ফের মন্থর হয়ে যাওয়ায় জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর একটাই জোর দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই যেন সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়, অন্যথায় এটি আবারও রাজনৈতিক খেলার শিকার হতে পারে।”

এই প্রসঙ্গে দৈনিক আলোকিত প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দা তারেক আল আজিজ বলেন, “ভারুয়াখালী-খুরুশকুল সংযোগ সেতু শুধু ইট-কাঠের কাঠামো নয়, এটি ৪০ হাজার মানুষের স্বপ্ন। এই সেতু নির্মিত হলে ভারুয়াখালীর মানুষ দীর্ঘ ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরে রামু হয়ে কক্সবাজার শহরে না গিয়ে মাত্র ৮ কিলোমিটারের মধ্যে সহজে পৌঁছাতে পারবে। ২০১৮ সালে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে চলা কাজ অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। এত বড় প্রকল্পে মাত্র ৫-৮ জন শ্রমিক কাজ করছেন, যারা মাঝে মাঝে বিভিন্ন অজুহাতে কাজ বন্ধ রাখেন। আমি এই সেতুর দ্রুত বাস্তবায়ন চাই এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ঠিকাদারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের এই অসহনীয় দুর্ভোগ এবং সেতুটির অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যাবশ্যক। এই সেতু শুধু দুটি এলাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে না, বরং এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এমনটাই মনে করছেন ভুক্তভোগী স্থানীয়রা। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, কবে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি পড়বে এবং কবে এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *