বিশেষ প্রতিবেদক:
আজ, ২০২৫ সালের ৫ মে, সেই ভয়ংকর রাতের এক যুগ পূর্তি। ২০১৩ সালের এই দিনে, ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরী ও রক্তে রঞ্জিত প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন সেখানে। গভীর রাতে, যখন ক্লান্ত দেহগুলো বিশ্রাম নিচ্ছিল, কেউ নামাজে মশগুল ছিলেন, কেউ জিকিরে, ঠিক তখনই নেমে আসে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্মম আঘাত। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির হাজার হাজার সদস্য নির্বিচারে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ হেফাজত কর্মী ও তওহিদী জনতার উপর। মুহূর্তের মধ্যেই অসংখ্য আলেম-ওলামা ও মাদরাসাছাত্র হতাহত হন, রাজপথ ভেসে যায় তাদের রক্তে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া লাঠিপেটায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকেন অনেকে। গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের বীভৎস শব্দে পুরো এলাকা যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে রূপ নেয়। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘শেখ হাসিনার শাপলা চত্বর গণহত্যা’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।
যে প্রেক্ষাপটে হেফাজতের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিবাদ:
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর, বাংলাদেশে তথাকথিত মুক্তমতের নামে মহান আল্লাহ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং ইসলামের মৌলিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যমে একের পর এক অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ লেখালেখি শুরু হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘থাবা বাবা’ ছদ্মনামে পরিচিত রাজীব হায়দার এবং ‘আকাশ মালিক’ ছদ্মনামে লেখা ব্লগার অভিজিৎ রায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুখে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বললেও, এই ব্লগারদের ইসলাম বিদ্বেষী কার্যকলাপের ব্যাপারে ছিলেন নীরব। যখন আলেম-ওলামারা ইসলাম অবমাননার প্রতিবাদ করতেন, তখন তাঁদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করা হতো। এই পরিস্থিতিতে, ২০১০ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামক একটি ধর্মীয় অরাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বেশ কিছু ইসলামি সংগঠনও এতে যোগ দেয়। হেফাজতে ইসলাম জানায়, ইসলামের অবমাননা প্রতিরোধ এবং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
আত্মপ্রকাশের পর, হেফাজতে ইসলাম আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি এবং ইসলামকে বিকৃত করে লেখালেখি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করতে থাকে। ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারা ইসলাম অবমাননা বন্ধ এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করে। এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে সরকারকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বৃহত্তর জমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
শাহবাগী গণজাগরণ মঞ্চ:
শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ছিল মূলত ইসলাম বিদ্বেষীদের একটি প্ল্যাটফর্ম। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এই মঞ্চ গঠিত হয়। সরকার ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য বিতর্কিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। কিন্তু বিচারের ব্যাপারে তারা সম্ভবত ভরসা পাচ্ছিল না। তাই ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে শাহবাগে তৈরি করা হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ফাঁসির দাবিতে জনমত তৈরি ও চাপ সৃষ্টি করা। তাদের স্লোগান ছিল ‘ফাঁসি চাই, দিতে হবে’। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাসহ অন্যদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষী সংগঠনগুলোর জমায়েতের মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চ একটি ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম শুরু করে এবং ইসলামের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালাতে থাকে। এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় হেফাজতে ইসলাম।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ঘিরে যা ঘটেছিল:
২০১৩ সালের ৫ মে, হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় আসেন। সেদিন ফজরের নামাজের পর থেকেই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে তৌহিদী জনতা জড়ো হতে শুরু করে। ঢাকা উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গীর আবদুল্লাহপুর এবং দক্ষিণে সায়েদাবাদের কাছে কাঁচপুর ও পোস্তগোলা ব্রিজসহ রাজধানীর ছয়টি প্রবেশমুখে লাখ লাখ মানুষ এসে সমবেত হন। সেখানে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি ব্যারিকেড তৈরি করে, ফলে ঢাকার প্রবেশমুখগুলো কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই জমায়েতে হেফাজতের আলেম-ওলামা ও মাদরাসাছাত্র ছাড়াও বিভিন্ন দল ও মতের সাধারণ মানুষও অংশ নেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জনতার স্রোত আরও বাড়তে থাকে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। শাপলা চত্বরে যাওয়ার অনুমতির জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের সাথে আলোচনা করা হলেও, পুলিশ প্রথমে অনুমতি দিতে গড়িমসি করে। দফায় দফায় আলোচনার পর, পুলিশ শুধু মোনাজাতের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ করার শর্তে অনুমতি দেয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে, মানুষের ঢল নামে শাপলা চত্বরের দিকে। দুপুর দেড়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে তৌহিদী জনতা মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়, যা অল্প সময়ের মধ্যেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
তবে শাপলা চত্বরে মিছিল আসার পথে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও পল্টন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর কর্মীদের বাধার সম্মুখীন হয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ দফায় দফায় গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও যুবলীগের কর্মীরা বায়তুল মোকাররমের বইয়ের দোকানে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়, যাতে পবিত্র কোরআন শরীফসহ বহু ইসলামি বই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বায়তুল মোকাররম মার্কেটে সোনার দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে এবং মসজিদের চারপাশের রাস্তায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয় এবং সন্ধ্যা নাগাদ সংঘর্ষে প্রায় ১৮ থেকে ২০ জন নিহত হন। তবে সরকার এই ঘটনার দায়ভার চাপিয়ে দেয় হেফাজতে ইসলামের ওপর। সন্ধ্যায় শাপলা চত্বরে হেফাজত নেতারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দেন। রাত ৮টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে দলের নেতাকর্মীদের হেফাজতকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিকাল ৪টার মধ্যে শাপলা চত্বর ত্যাগ করার হুমকি দিয়ে বলেন, সময়সীমার মধ্যে ঢাকা না ছাড়লে এর পরিণতি ভালো হবে না। একই সময়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সাথে সরকারের দফায় দফায় বৈঠক চলতে থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। লালবাগ মাদ্রাসায় অবরুদ্ধ হেফাজত আমির আল্লামা শফী ও অন্যান্য নেতাদের উপর শাপলা চত্বরের সমাবেশ বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। এক পর্যায়ে রাত ১০টায় তাঁকে সমাবেশের উদ্দেশ্যে রওনা করানো হলেও, পথে অসুস্থতার অজুহাতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পরে ডিবি প্রধান হারুন তাঁকে বিমানে করে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।
সফেদ টুপির উৎসব:
২০১৩ সালের ৫ মে, সারাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল যখন শাপলা চত্বরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ঢাকার পথে পথে যেন সাদা টুপির উৎসব চলছিল। শাহবাগ যে টুপিকে অবজ্ঞা করেছিল, সেই টুপির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী।
ভয়ংকর এক নৃশংস অভিযান:
শাপলা চত্বরের সমাবেশ ৬ মে সকাল পর্যন্ত গড়াতে থাকলে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন অবশ্যম্ভাবী – এমন আশঙ্কায় সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে হেফাজতের সমাবেশ ভণ্ডুল করার এক ভয়ংকর ও নৃশংস পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যত লাশই পড়ুক না কেন, রাতের মধ্যেই শাপলা চত্বর খালি করে ফেলতে হবে। ফলস্বরূপ, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সাড়ে সাত হাজার সশস্ত্র সদস্য ‘শাপলা অভিযান’-এ অংশ নেয়। আরও কয়েক হাজার সদস্যকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখা হয়। এদের সাথে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও সক্রিয় ছিল। রাত ১টার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থান নেয়। পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ ও বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ নামের এই অভিযান শুরু হয় রাত পৌনে ৩টায়। এর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় পুরো মতিঝিল ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়। একযোগে চালানো এই অভিযান কতটা ভয়ংকর ছিল, তা ব্যবহৃত গোলাবারুদের হিসাব থেকেই স্পষ্ট। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য গরম পানির গাড়ি ও আর্মার্ড কার ব্যবহার করা হয়। অসহায় আলেম-ওলামা ও মাদরাসাছাত্রদের ওপর চালানো এই অভিযান ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর ঢাকায় পরিচালিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ভয়াবহতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
অভিযানের সময়, হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক মতিঝিল এলাকায় সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর, তাঁদের হাত উঁচু করে লাইন ধরে বের করে আনা হয়। তাঁদের চোখেমুখে ছিল অজানা আতঙ্ক ও ভয়। তখন হেফাজতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শাপলা গণহত্যায় আড়াই হাজার নিহত ও দশ হাজারের বেশি আহত হওয়ার কথা বলেছিল। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ পরবর্তীতে তথ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের রিপোর্টে ৬১ জন নিহতের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করে। শাপলার গণহত্যা সরাসরি সম্প্রচারের অভিযোগে হাসিনা সরকার দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামী টেলিভিশনকে ‘সাময়িকভাবে’ বন্ধ করে দেয়। এই ‘সাময়িক বন্ধ’ শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানোর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হয়, শাপলা গণহত্যায় অন্তত ৩০০ জন নিহত হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংস্থা একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে শাপলা গণহত্যায় নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা উদ্ঘাটন এবং এর সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে।